ঢাকা প্রতিনিধি: বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতে ২০২৩ সালে কমপক্ষে ৪৫ জন নিহত হয়েছেন আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৬ হাজার ৯৭৮ জন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
রোববার (৩১ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৩: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর পর্যবেক্ষণে’ এমন তথ্য জানান আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল।
আসকের তথ্য মতে, ২০২৩ সালেও শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশে বাধা দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গায়েবি মামলা, রাজনৈতিক গ্রেফতার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, হেফাজতে নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইনবহির্ভূত আচরণ, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করার অভিযোগ, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।
আসকের মতে, বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা কিছুটা কমে এলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। বরং আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে পুলিশ, র্যাব ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা। বন্ধ হয়নি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাও।
সংবাদ সম্মেলনে ২০২৩ সালে দেশের নির্বাচনি ও রাজনৈতিক সহিংসতার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। একইসঙ্গে পরিসংখ্যানে নারী ও শিশু নির্যাতন, পোশাক শ্রমিক সংক্রান্ত তথ্য, সীমান্তে হত্যার পরিসংখ্যান, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক নির্যাতন, সীমান্তে হত্যা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের চিত্রও উঠে এসেছে।
আসকের মতে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বন্দুকযুদ্ধ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কিছুটা কমে এসেছে। আসকের হিসেবে ২০২২ সালে ১৯ জন নাগরিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল, বিপরীতে এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০ জন।
নির্বাচন ও রাজনীতি বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করে, প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করায় ইতিমধ্যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং অংশগ্রহণমূলকতা নিয়ে দেশে বিদেশে নানা প্রশ্ন ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। এ বছরও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা, গায়েবি মামলা, হামলা, গণগ্রেপ্তার, পরিবহন ধর্মঘট ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে। গণমাধ্যম সূত্রে আসক জানায়, ২০২৩ সালে রাজনৈতিক সংঘাতে নিহত হয়েছে কমপক্ষে ৪৫ জন এবং আহত হয়েছে কমপক্ষে ৬৯৭৮ জন।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, ২০২৩ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৫৭৩ জন নারী।
দেশের মানবাধিকার রক্ষায় সরকারের প্রতি কয়েক দফা সুপারিশ তুলে ধরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল এসব সুপারিশমালা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, দমানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়নও সরকারের দায়িত্ব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও সমঅধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। পরে সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়।
আসকের সুপারিশগুলো হলো-
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন- বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার বহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সাথে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে এবং সম্পৃক্তদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে।
এ পর্যন্ত সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের যে কোনো নাগরিককে আটক বা গ্রেফতারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
মিথ্যা মামলা বা গায়েবি মামলা সংক্রান্ত যে অভিযোগসমূহ উঠেছে সেগুলো আমলে নিয়ে অভিযোগের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
নাগরিকের সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি এবং জনদুর্ভোগ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারীত্বের আওতায় রেখে তাদের কর্ম-পরিধি নিশ্চিত করতে হবে।
নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি রোধে কার্যকর ব্যবস্থ্যা গড়ে তোলার জন্য তদন্ত সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে তার জন্য পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ বিশ্বাস ও রীতি চর্চার অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
মানবাধিকারকর্মী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ দ্রুততার সাথে সংশোধন করতে হবে। কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অংগ্রহণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সমতলের আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার এবং সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
কাঙ্খিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ভোগের পরিবেশ তৈরি করতে হব।
সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মস্থলে পরিবারসহ বাধ্যতামূলক অবস্থানের জন্য পূর্বের ন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও সহযোগিতায় বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর চালুসহ অন্যান্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো যেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে এবং সমঝোতার মাধ্যমে সকল সমস্যা সমাধান করে, সে ব্যাপারে সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন আসকের চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না, জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির, সমন্বয়ক তামান্না হক রীতি প্রমুখ।
https://slotbet.online/