ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আনিসুর রহমান সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। রোগীদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
আনিসুর রহমানের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার চাম্পাতলি গ্রামে। বাবার নাম আমিনুল ইসলাম। বাবা-মায়ের ৫ সন্তানের মধ্যে আনিসুর ২য়। বাবা এক সময় ঠাকুরগাঁওয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে মালিকের গাড়ি চালাতেন। আনিসুর প্রথমে মাইক্রোবাসের হেলপারের কাজ করতেন। পরে ধীরে ধীরে মাইক্রোবাসের চালক হয়ে উঠেন।
মাইক্রোবাস চালানোর সুবাদে হাসপাতালের ডাক্তার ও কর্তাবাবুদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। পরে ২০০৪ সালে জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চালক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ২০০৯ সালে বদলী নিয়ে ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে চলে আসেন (যার বর্তমান নাম ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল)। ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেন আনিসুর। বর্তমানে তিনি নামে বেনামে গাড়ি, বাড়ি ও সম্পদের মালিক হয়েছেন। ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের সামনে তার ৫টি এ্যাম্বুলেন্স গাড়ি চলাচল করে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। এছাড়াও পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে নামে-বেনামে জমি ক্রয় করে হয়ে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক।
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ বিধি মোতাবেক কেউ রোগী পরিবহনের জন্য সরকারি এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিলে কিলোমিটার প্রতি ১০ টাকা হারে ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাল থেকে রোগী রেফার্ডের হাসপাতাল রংপুর মেডিকেল এবং দিনাজপুর মেডিকেল। ঢাকায় যেতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। এর বাইরে অন্য কোন জেলায় যাওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে রংপুর মেডিকেলে রোগী পরিবহন ভাড়া ২,১৬০ টাকা এবং দিনাজপুরে মেডিকেলে পরিবহন ভাড়া ১,১৪০ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি রংপুরে রোগী পরিবহন করেছেন ২৭৯ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ৩২০০-৪২০০ টাকা হারে ১০,২১,১৪০ টাকা। সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৬,০২,৬৪০ টাকা। দিনাজপুরে রোগী পরিবহন করেছেন ৫৬ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ১৮০০-২১০০ টাকা হারে ১,০৯,২০০ টাকা, সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৬৩,৮৪০ টাকা।রাজশাহীতে রোগী পরিবহন করেছেন ১ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ১৪,০০০ টাকা, সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৭,৮০০ টাকা এবং ঢাকায় রোগী পরিবহন করেছেন ২ বার, ভাড়া আদায় করেছেন ৩৮,০০০ টাকা। সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছেন ১৮,০০০ টাকা। রংপুর মেডিকেলে ২১ বার ফ্রিতে গর্ভবতী রোগী পরিবহনের কথা উল্লেখ করা হলেও প্রকৃত পক্ষে ৩-৪ জন ছাড়া কোন রোগীকেই ফ্রিতে পরিবহন করা হয়নি।
২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে ২০২৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রোগীদের জিম্মি করে ভাড়া আদায় করেছেন ১১,৮২,৩৪০ টাকা প্রায়। সরকারি কোষাগারে জমা করেছেন ৬,৭৩,৯৮০ টাকা। পকেটস্থ করেছেন ৫,০৮,৩৬০ টাকা। তিনি এই সময়ে সরকারের কোষাগার থেকে মেইন্টেনেন্স বিল বাদ দিয়ে ফুয়েল ও মবিল বিল নিয়েছেন ১৬,৮৯,৪১৪ টাকা। রাজশাহীতে রোগী পরিবহনের কোন অনুমতি না থাকলেও বিধি বর্হিভূত ভাবে রোগী পরিবহন করেছেন তিনি।
সরকারি এ্যাম্বুলেন্সে কোন যাত্রী উঠানোর নিয়ম না থাকলেও রোগীকে পৌছে দিয়ে ফিরে আসার সময় নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করে আসছে আনিসুর। কখনো কখনো হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স অকেজো দেখিয়ে নিজের মালিকানা গাড়িতে রোগী পরিবহন করাতেন তিনি। তার থাকার জন্য আবাসিকের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে তিনি অবস্থান না করে সেই আবাসিকে অবস্থান করতো তার বড় ভাই ও ভাগ্নেরা।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার সালন্দর শিংপাড়া গ্রামের মাজেদুর রহমান বলেন আমার বাবা অসুস্থ হলে ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে ভর্তি করাই। পরে ডাক্তার রংপুরে রেফার্ড দিলে এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয়। সে জন্য হাসপাতালের ড্রাইভার প্রথমে ৫ হাজার টাকা ভাড়া চায়। পরে ৪২০০ টাকায় রংপুর মেডিকেলে যেতে হয়। একই ইউনিয়নের সফিউল ইসলাম বলেন আমার শ্বাশুরী অসুস্থ হলে ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে ডাক্তার রেফার্ড দিলে সরকারি গাড়িতে রংপুরে নিয়ে যাই, রংপুরে পৌছার পরে ড্রাইভার আমাদের কাছে ৩২০০ টাকা ভাড়া নেয়। নওগাঁ জেলার মো. শাহেদুল ইসলাম বলেন গত ২৮ জানুয়ারি আমার আত্নীয়কে ঠাকুরগাঁও হাসপাতাল থেকে সরকারি এ্যাম্বুলেন্সে রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে আসার জন্য ড্রাইভার আমাদের কাছে ১৬ হাজার টাকা ভাড়া চাইলে পরে ১৪ হাজার টাকায় আসতে হয়।
সম্প্রতি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার সাকোয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন আমার স্ত্রীর শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে ডাক্তার রংপুরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। যেখানে ঠাকুরগাঁও থেকে রংপুর মেডিকেলের ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা। কিন্তু ৫ হাজার টাকার নীচে কোন গাড়িই যাবে না। আবার অনেকে যেতে চাইলে আরেকজন এসে বাঁধা দেয়। আমরা সব কিছুতেই যেন জিম্মি হয়ে পড়েছি।
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আনিসুর রহমান বলেন আমার তো গাড়ি নাই, আমার ভাইর গাড়ি আমার হবে কি ? বন্ধুর গাড়ি আমার হবে কি ? ভাগিনার গাড়ি আমার হবে কি ? সরকারি আবাসিকে আমার ভাই-ভাগিনা থাকে না। ভাইয়ের জন্য খাওয়া নিয়ে আসি সেখানে শুধু খাওয়া করে। ভাগিনারা তাদের নিজ নিজ গাড়ি চালায়। আমার ভাইয়ের গাড়ি একটা, বড় দুলাইভাই’র ছেলে দুইজন গাড়ি চালায়। ছোট বোনের ছেলে একটা গাড়ি চালায়। সিন্ডিকেটের বিষয়ে বলেন পাবলিক গাড়ি গুলোই বেশী সিন্ডিকেট করে, তারা জনগণের কাছে থেকে বেশী ভাড়া নেয়।
ঠাকুরগাঁও এ্যাম্বুলেন্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন মাহমুদ মামুন বলেন আনিসুরের ৫টি গাড়ি চলাচল করে। গাড়ি গুলো নামে বেনামে চলে। গাড়ি গুলো তার মা, ভাই ও ভাগিনার নামে রয়েছে। এগুলো কথা বলতে গিয়ে আমার উপর হামলা আসে এবং হুমকি প্রদান করে। এ্যাম্বুলেন্স সমিতির প্রচার সম্পাদক বাবুল ইসলাম বলেন আনিসুর রহমান তার ভাইকে একটা গাড়ি কিনে দিয়েছে, তার ভাগিনাকে গাড়ি কিনে দিয়েছে। কেউ যদি কিছু কম ভাড়ায় যেতে চায় তাহলে তাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি প্রদান করা হয়।
জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য সামিরুল রহমান জয় চৌধুরী বলেন আমরা জেনে আসছি হাসপাতালের রোগীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে আসছে আনিসুর। তার ৫-৭টা এ্যাম্বুলেন্স চলাচল করে। আর এ সব করছে সে কোন প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে।
ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা: মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে আমরা তার ট্যাক্সের রির্টান দাখিলের কাগজপত্র যাচাই করি। সেখানে কোন অসংগতি না থাকায় আমরা বৈধ হিসেবে ধরে নেই। তবে এর বাইরে যদি কিছু থাকে তাহলে এর দায় তাকে নিতে হবে।
https://slotbet.online/