ঠাকুরগাঁয়ের সর্বস্তরের সাংস্কৃতিক কর্মীরা চৈত্রের দুপুরের দাবদাহে প্রতিবাদী ব্যানার নিয়ে চৌরাস্তায় মানববন্ধন করেছে। প্রধান কারণ হলো গত ৩৯ বছরে ৩৪ বছর ধরে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে থাকে আলপনা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ। এই মেলায় জুয়া নাই , যাত্রা নাই , রাজনীতি নাই। কয়েকদিন ধরে সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু এবং মিলন মেলায় পরিনত হয়। এ বছর মেলার অনুমতি পায়নি। অবশ্য এর আগে কখনোই অনুমতি লাগেনি।
মানববন্ধনের একটা চাপ অবশ্যই আছে। এই চাপ কমানোর জন্য আবেদন নিয়ে প্রশাসন বৈশাখী মেলা করার অনুমতি দিয়েছে। যাদেরকে আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে , তারা ২২ এপ্রিল প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন ২০ এপ্রিল ২১ দফা শর্ত দিয়ে ২১ থেকে ২৪ এপ্রিল ৪ দিন মেলা করার অনুমতি পাওয়া গেছে।
শর্তগুলোর মধ্যে যা যা করা যাবে না উল্লেখ আছে সেসবের অধিকাংশ এই মেলায় হয়ই না। তার মধ্যে কিছু শর্ত গৎ বাধা হলেও বেশ কয়েকটা আছে যা মেনে মেলা করা যাবে না। ৪ দিনের এই মেলা রাত নটার মধ্যে শেষ করতে হবে। মাগরিবের আযান থেকে এশার নামাজ শেষ হয়ে বাজে ৯-৩০।
আয়োজক কমিটির সকল সদস্যের এন আইডি , ছবি , আইডেনটিটি কার্ড , স্বেচ্ছাসেবকদের এই সব কাগজপত্র , আইডি কার্ড , নিজ খরচে প্রতিটি দোকানে সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে হবে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পাশাপাশি জেনারেটর ব্যবস্থা রাখতে হবে। যে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে তার সম্পুর্ন দায় আয়োজকদের। মেলা আয়োজনে বা নিরাপত্তার বিষয়ে পুলিশের বা প্রশাসনের সামান্যতম দায় নাই।
আয়োজকরা নিরুপায় হয়েই বলে দিলেন , এবারের মেলাটা করা গেল না। এ ছাড়া তারা কিইবা বলতে পারতেন। তবে আশার কথা নিরাপত্তা জামানতের কথা বোধ হয় মনে পড়েনি, মনে পড়লে ওটাও শর্তের মধ্যে হতে পারতো।
এ বিষয়ে ২২ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের মিলনায়তন ভর্তি মিডিয়া কর্মীদের নিয়ে, আলপনা সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন। বিষয়টা গ্রহণযোগ্য না হলেও মনে হলো ক্ষোভে ফেটে পড়লো সাংবাদিকরা।
তাদের প্রশ্ন এবং বক্তব্যে তার প্রমান পাওয়া যাচ্ছিল। আমরা আশাবাদী হতে শুরু করলাম , ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিকরাও এই সুস্থ্য বিনোদন এবং বৈশাখী মেলার মাধ্যমে সুস্থ্য সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত থাকুক এটা চায়।
অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে মনে হলো এতোদিন পর হয়তো সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন এক ছাতার তলে আসবে।
জানা গেল এখন ডিসি অফিসে কোন জাতীয় দিবসের প্রস্তুতি সভায় কোন সংগঠনকেই চিঠি দেওয়া হয়না। ফলে মোটামুটিভাবে সবাই আক্রান্ত। আশা করা যায় সাংস্কৃতিক কর্মীরা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববে। যদিও কোন অনুষ্ঠানে কাকে চিঠি দেওয়া হবে এটাতো ডিসি অফিসের ব্যাপার। জেলা প্রশাসনতো চিঠি দিতে বাধ্য না।
হলঘরে বিভিন্ন বয়সী সাংবাদিক ছিলেন। তাদের পরিমানও কম নয়। কে কোন্ কাগজের বা মিডিয়ার সে প্রশ্ন করার এখতিয়ার আমার নাও থাকতে পারে তবে, প্রশ্নের প্রক্ষিতে কিছু প্রশ্ন তো করা যায়।
বেশ কয়েকজন খুবই জোড়ালো কন্ঠে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন , জেলা পরিষদের মেলা চলছে মধ্যরাত পর্যন্ত , রুহিয়াতে মেলা হচ্ছে , রানীশংকাইলে মেলা হচ্ছে , তাদের এই সব শর্ত দেওয়া হয়েছে কিনা ?
সাংবাদিকতার জ্ঞান সম্পন্ন কোন ব্যক্তি এই প্রশ্ন করবেন না। কেন না শর্ত দেওয়া হয়েছে কি না সে জবাব আলপনা সংসদ কি করে দিবে? এই প্রশ্নতো সাংবাদিকরা করবেন ডিসি সাহেবকে। আলপনা সংসদের বৈশাখী মেলা করার দাবী জানাবেন আর জেলা পরিষদের মেলা চ্যালেঞ্জ করবেন তা হয় কি করে।
হ্যাঁ সাংবাদিক হিসাবে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে পারেন , মেলায় অনৈতিক কিছু হচ্ছে কিনা , কোন জুয়া খেলা হচ্ছে কিনা, জনস্বার্থ বিরোধী কিছু হচ্ছে কিনা? ওখানে শর্ত না থাকলে এ মেলায় শর্ত থাকবে কেন? আমারতো শংকা হচ্ছিল আজকে এই সুযোগে সাংবাদিকরা হয়তো প্রশ্ন করেই বসবেন , প্রেস ক্লাবের নির্বাচন অনুষ্ঠানে ডিসি সাহেব বা আদালত কোন শর্ত দিয়েছে কিনা ?
হলঘরে সাংবাদকদের উপস্থিতি , প্রশ্নবাণে আয়োজকদের জর্জরিত করা , প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা দেখে আমার মনে হলো পরেরদিন আলপনার এই মেলা বন্ধের প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কোন বিষয় মিডিয়াতে জায়গাই পাবে না। কিন্তু তাতো হলো না। এমনকি ফেসবুকও তো ততটা সোচ্চার নয়। তাহলে কি ধারণা করবো , নাস্তার প্যাকেট এবং আরো কিছু বিষয় আশায় বিবেচনা না করায় সংবাদ আসেনি নাকি মিডিয়াতে তাদের চলাচল নাই।
প্রতিটি জেলা শহরে কিছু সাংগঠনিক ব্র্যান্ড থাকে। ঠাকুরগাঁয়ে তেমনি কয়েকটি ব্র্যান্ড আছে। তার মধ্যে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান মানে নিক্কন সঙ্গীত বিদ্যালয়। তারা বর্ষবরনের অনুষ্ঠান করে একদম রমনার বটমুলের আদলে। সরকারের কোন খরচ ছাড়াই কি চমৎকার আয়োজন হয়। এখন নববর্ষের অনুষ্ঠান সরকারিভাবে পালন করা হয়।
সরকারি প্রোগ্রাম মানে ১০ মিনিটের একটা শোভাযাত্রা , স্টেশন ক্লাবে গিয়ে পান্তা খাওয়া , এবার আবার সেট্ওা নাই। এরপর অভিজাতদের জন্য ছোটখাট আলোচনা এবং ২টা নাচ আর গোটা চারেক গান। কবে জানি শুনতে হবে নববর্ষের ভোরে গানের অনুষ্ঠান করা যাবে না।
দেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর ৭১। কিন্তু গর্বের সাথে উচ্চারণ করা যায় , ঠাকুরগাঁও এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ঠাকুরগাঁও ছাড়া করেছিল দেশের বিজয় অর্জনের ১৪ দিন আগেই। এর পর স্বাধীনতার পর ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে , কেউ মনে করতে পারলোনা এই গৌরবের কথাটা।
৭১ থেকে ২০০৯ এই ৪০ বছরে যারা জন্ম নিয়েছে তাদের কাউকেই এই গৌরবের কথাটা শোনানোর কথা কারো মনে হলোনা। ৪০ বছর পর উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি ( একুশে পদক প্রাপ্ত ) প্রথম উদযাপন করে ৩ ডিসেম্বর ‘ঠাকুরগাঁও পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত দিবস’।
ঠাকুরগাঁওয়ের সর্বস্তরের মানুষের কি যে উচ্ছাস , বীরমুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ , স্বাধীনতা যুদ্ধ জয়ের স্মৃতি বিজরিত স্মরণ স্থাপনা শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ , অপরাজেয় একাত্তর , ঠাকুরগাঁওয়ের প্রথম শহীদ মোহাম্মদ আলী , শিশু নরেশ চৌহানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন , পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি মুর্যাল স্তাপিত হলে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনন্দ শোভাযাত্রা শেষ হতো। শোভাযাত্রায় হাতী ঘোড়া , ফায়ার সার্ভিসের আউট রাইডার , জাতীয় পতাকা সজ্জিত গাড়ী , ব্যান্ড পার্টি সহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ব্যানার ফেষ্টুন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী , সমাজ কর্মী সাংস্কৃতিক সংগঠন , ছাত্র সংগঠন সহ সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠিত হতো দিনব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের চিত্র প্রদর্শনী, বিকেলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পরিবেশনা , জনপ্রতিনিধি , সুধীগনের অংশগ্রহনে আলোচনা সভা, ২/১ জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার সম্বর্ধনা এবং, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে সেলাই মেসিন প্রদান ।
১২ বছরে উদীচী ঠাকুরগাঁও জেলার ১০৫ টি পরিবারকে এই সেলাই মেসিন দিয়েছে। উদ্বোধন করতেন মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠকগণ এবং সন্ধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চারণ, বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। কিশোর তরুণ দর্শক শ্রোতা অবাক বিষ্ময়ে সেসব মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। রাতে অনুষ্টিত হতো দেশ বিদেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। হতো আতশবাজি , ফানুশ উড়ানো। আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে কখনো কখনো পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।
কৃতিত্বের ভাগ কে ছাড়তে চায়। হঠাৎ করেই সরকারি দলের প্রেষ্টিজে লাগলো , এতো বড়ো সার্বজনীন একটি আয়োজন তো তাদের করারই কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। ২ বছরে এটার দলীয় প্রোগ্রামের অবয়ব পাওয়ার কারনে সার্বজনীনতা হারালো। আরো পরে এটা সরকারী ভাবে করা হচ্ছে । সরকারি প্রোগ্রামের সুবিধা হলো এটার আয়োজনে কারো দায় থাকেনা। ভাল মন্দ যাইই হোক জেলা প্রশাসন এটা দেখে। আর একটা সমস্যা তা হলো সরকারি নির্দেশনার বাইরে কিছু করার সুযোগ কম। ১০ মিনিটের একটা শোভাযাত্রা শেষ ক’রে আলোচনা সভা , ফেসবুকে ছবি আপলোড এবং তারপরই তৃপ্তির ঢেকুর। তবে উদীচী এখনো সারাদিনের প্রোগ্রামই করে। এখানে যারা অংশগ্রহণ করে তারা সব দলের এবং সংগঠনের। হয়তো শীঘ্রই জানা যাবে যে সব প্রোগ্রাম সরকারি ভাবে হবে , সেই সব প্রোগ্রাম বেসরকারি উদ্যোগে করা যাবেনা।
বিজয় মেলা মানে কর্ণেট সাংস্কৃতিক সংসদ। খুব ভালো ভাবেই তারা বিজয় মেলাটা পরিচালনা করে। করলে কি হবে , কোথায় কি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে , আয়োজকরা আর মেলা আয়োজনের সাহস করছেননা।
সবকটি আয়োজনেই আছে বাঙ্গালী জাতীয় জীবনের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংশ্লিষ্টতা।
সরকার বৈশাখী ভাতা দেয় নববর্ষ উদযাপন করার জন্য। অথচ নববর্ষের এই সব আয়োজনে সহায়তা থাকবেনা এই বৈপরিত্য কেন? মনে রাখতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতি কর্মীদের অবদান কোন অংশে কম ছিল না।
শিল্পী সাহিত্যিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল তৈরিতে অনবদ্য ভুমিকা পালন করেছেন। সরকার দাবী করে সংস্কৃতি বান্ধব , কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রমান তো খুব শক্ত ব্যপার হয়ে গেলো। ৩ যুগ ধরে খুবই সফলতার সাথে চলে আসা বৈশাখী মেলার জন্য মানববন্ধন , সংবাদ সম্মেলন করতে হচ্ছে।
সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষের বক্তা উদীচীর সভাপতি সেতারা বেগম এই কথাগুলো স্মরণ করে দিলেন। আমাদের কেমন জানি মনে হচ্ছে , কারো অপছন্দের তালিকায় পড়েছে বৈশাখী মেলা। যিনি বা যারা এটা অপছন্দ করেছেন তারা কাজটি ভালো করেননি , এটা কি অপ্রমানিত থাকবে?
ছন্দের তালিকায় পড়েছে বৈশাখী মেলা। যিনি বা যারা এটা অপছন্দ করেছেন তারা কাজটি ভালো করেননি , এটা কি অপ্রমানিত থাকবে?
https://slotbet.online/