দেশের মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াতে বহুল ব্যবহৃত যানবাহনের মধ্যে মিনিবাস একটি। সর্বোচ্চ ৩১ আসনের এ যান শহরাঞ্চল ও স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে বেশি জনপ্রিয়। বাংলাদেশে নিবন্ধিত মিনিবাস রয়েছে ২৮ হাজার ৩২২টি। কিন্তু এর মধ্যে ১৯ হাজার ৬৪৬টির বয়স ২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি, যা মোট নিবন্ধিত মিনিবাসের ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মানদণ্ড অনুযায়ী, এসব মিনিবাস মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এগুলোর ‘ইকোনমিক লাইফ’ বা অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ।
মেয়াদোত্তীর্ণ মিনিবাসের একটা বড় অংশ চলাচল করে ঢাকা মহানগরে। ঢাকা মহানগরের জন্য এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ১৫৮টি মিনিবাসের নিবন্ধন দিয়েছে বিআরটিএ। এর মধ্যে ইকোনমিক লাইফ অতিক্রম করেছে ৬ হাজার ৪৭৮টি। পুরনো হয়ে যাওয়া এসব লক্কড়ঝক্কড় বাসে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে রাজধানীবাসী।
শুধু মিনিবাস নয়, বাস (৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসন), ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকারের মতো বাণিজ্যিক পরিবহনেরও ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করে দিয়েছে বিআরটিএ। বাস-মিনিবাসের ইকোনমিক লাইফ ২০ বছর। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকারের ২৫ বছর।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, সারা দেশে নিবন্ধিত বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকার রয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৬১২টি। এর মধ্যে ইকোনমিক লাইফ অতিক্রম করেছে ৭৩ হাজার ৫৭টি। এ হিসাবে দেশের নিবন্ধিত বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকারের ২৫ দশমিক ২২ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেস না থাকা পরিবহনের কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কে বিকল হয়ে তৈরি করে যানজট-বিশৃঙ্খলা। এসব যানবাহনের কারণে পরিবেশ দূষণও বেশি ঘটে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান মনে করেন, ইকোনমিক লাইফ যেকোনো গাড়ির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘কোনো গাড়ির ইকোনমিক লাইফ শেষ হয়ে গেলে ভারি মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মালিকরা তা করেন না। ফলে এসব গাড়ি আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এগুলো পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে; দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে; সড়কে বিকল হয়ে যানজট ও বিশৃঙ্খলা বাড়াচ্ছে।’
বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, ‘বিভিন্ন সময় পাইকারিভাবে ফিটনেস হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় যেভাবে ছাড় দেয়া হয়েছে, সেটারই ফল এটা। ২০১০ সালের দিকে বিআরটিএ ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোর নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে সে অবস্থান থেকে সরে এসে সংস্থাটি জরিমানাসহ ফিটনেস হালনাগাদের সুযোগ করে দেয়।
পরবর্তী সময়ে আবার জরিমানা ছাড়াও একই সুযোগ দেয়, যা এখনো চলছে। কোনো এক অদৃশ্য কারণে বিআরটিএ বারবার যানবাহনের, বিশেষ করে বাণিজ্যিক যানবাহনের ফিটনেসে ছাড় দিয়ে যাচ্ছে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছে। আমি মনে করি, ইকোনমিক লাইফ শেষ হওয়ার পর মোটরযান স্ক্র্যাপ করার বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিআরটিএকে এক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।’
২০২৩ সালের মে মাসে বিআরটিএ এক প্রজ্ঞাপনে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকারের ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করে দেয়। অবিলম্বে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের কথা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি। উল্টো একই বছরের আগস্টে প্রজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন মালিকদের চাপে বিআরটিএ পিছু হটে।
এমন অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘ইকোনমিক লাইফ অতিক্রম করা ৭৩ হাজার বাস-ট্রাকের একটি তালিকা আমরা এরই মধ্যে তৈরি করেছি। এ তালিকা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, পুলিশ, পরিবহন মালিকসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের দিয়েছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে যত গাড়ি নিবন্ধন হয়েছে, তার হিসাব বিআরটিএর কাছে আছে। কিন্তু এ সময়ে কত গাড়ি অফরোড হয়ে গেছে, তার হিসাব নেই। আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছি, যেন সড়কে চলাচল করা মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকৃত গাড়ির সংখ্যা নির্ধারণ করা যায়। এটা করতে পারলে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে।
আরএম/ টাঙ্গন টাইমস
https://slotbet.online/