কে এম কামরুজ্জামান সেলিমের একটা বাস্তব পর্যবেক্ষণ
আমার যেখানে বাড়ি তার আশেপাশে প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মের অনুসারী। আমি যেসব জেলায় চাকুরি করেছি সেখানেও সনাতনী ধর্মের অনুসারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল । আবার, আমার বাবার চাকুরি সূত্রে যেসব জেলায় আমি বসবাস করেছি, সেসব জেলাগুলোতেও ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী।
অর্থাৎ ছোট বেলা হতেই আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে একসাথে বড় হয়েছি। কখনো কে কোন ধর্মের এটা ঘুণাক্ষরেও আমার মনে আসেনি। একইভাবে আমার অন্যান্য বন্ধু যারা মুসলিম সম্প্রদায়ের তারাও আমার মতোই মনোভাবাপন্ন দেখেছি। তারা ভিন্ন মনোভাব পোষণ করলে এ সুদীর্ঘ সময়ে কোন না কোন সময় তাদের আচরণে সেটা বুঝা যেত। কিন্তু তেমনটি কখনো হয়নি। কে কোন ধর্মের, আমরা বুঝতাম কেবল যখন পুজা, ইদ বা বড়দিন আসত তখন। কারণ তখন নাড়ু, মুড়ি-মুড়কি খাওয়ার সুযোগ পেয়ে বুঝা যেত আমার বন্ধুটি সনাতনী ধর্মের ।
এমনকি আমি যে স্কুল হতে এসএসসি পাশ করেছি সেখানেও আমার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ডা.উত্তম দেওয়ান। ক্লাসের প্রথম স্হানটা নেওয়ার ক্ষেত্রে তার এবং আমার ছিল প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তার ধর্ম বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদের বন্ধুত্বে কখনও প্রভাব ফেলেনি। এখনও সে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। আগামী পরশু উত্তম খুলনা হতে ঢাকা আসবে, আমরা ঢাকার সব বন্ধুরা আড্ডা দিব, মজা করবো। আমার মতোই বাংলাদেশের সবারই অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশের মানুষরা সবাইকে মানুষ হিসেবেই দেখে, কে কোন ধর্মের অনুসারী সেটা নিতান্তই গৌণ। আমার হিন্দু বন্ধুরাও আমার সাথে একমত হবেন।
এখনও আমি যখন বাড়ি যাই, তখনও বাজারে বন্ধু অনিন্দ্যর ডেকোরেটরের দোকানে বসে আড্ডা দেই, সেই আড্ডার অর্ধেকই মুসলিম ভিন্ন অন্য ধর্মের বন্ধু। কত ধরনের আলোচনা হয়, কেউ কখনো বলতে শুনি নাই, তারা ইনসিকিউরড ফিল করছে বা অন্য কোন ধর্ম বিষয়ক সমস্যা আছে। লোহাগড়ায় এখনো অরবিন্দ স্যার, অসিত স্যার, অনিদ্য স্যার সর্বজন শ্রদ্ধেয়- কোন মুসলমান সম্প্রদায়ের কেউ এতটা শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারেননি। কেউ বলেনি হিন্দুদের এত শ্রদ্ধা জানানোর কী আছে ?
আবার, যখন আমি চাকুরিতে ঢুকলাম, তখনও সবার মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দেখেছি। কে কোন ধর্মের এটা কখনো ভাবা হয়নি। এমনকি ব্যাচ ভিত্তিক আমাদের যে কমিটি ছিল, সেখানেও দীর্ঘ সময় হিন্দু ধর্মের বন্ধুরা নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা তাঁদের নেতৃত্ব গোবেচারার মতো মেনে চলেছি। কখনো বলিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মাত্র ৫/৬ জন অফিসার আছে ২০০ জনের মধ্যে, তারা কেন নেতৃত্ব দিবে? মেজরিটি সম্প্রদায়ের অফিসার নেতৃত্ব দিবে বা এটাও বলিনি আমরা মেধায় বিসিএস চান্স পেয়েছি, কোটার এবং মাইনরিটি কারও নেতৃত্ব মানবো না। বরং তাদের সব সময় সহযোগিতা করেছি এবং বন্ধুপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছি।
আবার, পোস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও কখনো বলিনি বা মনেও কখনও আসেনি যে, ব্যাচের হিন্দু সম্প্রদায়ের অফিসারের জননিরাপত্তা, স্বাস্হ্য সেবায় বা শিল্পে পদায়ন হয়, আমার মেধাক্রম, রেজাল্ট, ডিগ্রি ভালো থাকার সত্বেও আমার কেন কৃষিতে বা আরইবি’তে হয় বা জেলা প্রশাসক হিসেবে তারা বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পদায়ন পায় এবং ৪ বছরের অধিক সময় ডিসিগিরি করে, আর আমি কেন ছোট জেলায় পদায়ন পাই, আবার ৩ বছরের আগেই তুলে নিয়ে আসে, যদিও যেকেউ এখনও নিরপেক্ষ সার্ভে করলে দেখতে পাবে আমার জনসম্পৃক্ততা ও জনবান্ধব কাজ কারও হতে খারাপ ছিল না। আমি সবসময় মনে করেছি তারা আমার চেয়ে অধিকতর যোগ্য-তাই ভালো পোস্টিং পেয়েছে অথবা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যথাযথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়নি- এতে আমার বন্ধুর কোন দোষ নেই। আমার বিশ্বাস ব্যাচের অন্যরাও একই ধরনের চিন্তা করেছে। ফলে ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে ব্যাচের সবার মধ্যে একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে আজ অব্দি।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবজায়গায় একই চিত্র দেখা যাবে। এটাই আমাদের শক্তির সবচেয়ে বড় জায়গা। কেউ এটা দূর্বলতা ভাবলে সবচেয়ে বড় ভুল করবে- সে যত বড় শক্তিশালী গোষ্ঠী বা দেশই হউক না কেন! তবে এটা ঠিক, মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল বা ২/১ টি চিহ্নিত রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে ফায়দা যে হাসিল করতে চায় না, বিষয়টা তেমনও নয়। এ ধরনের অপচেষ্টা আগেও হয়েছে, বর্তমানেও করার চেষ্টা চলছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। এই অপচেষ্টা যেন সফল না হয় সেজন্য আমাদের সবারই যার যার অবস্থান হতে দায়িত্ব আছে।
পূর্বে অনেকে গল্প, কবিতা, গান বা উপন্যাস লিখে প্রোমোশন বা ভালো পোস্টিং পেয়েছেন, এখন বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাত গুটিয়ে না থেকে যার যার শক্তির জায়গা হতে জনমত গড়ে বাংলাদেশের চিরন্তন সামপ্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখা উচিৎ। হিন্দু -বৌদ্ধ – খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের যারা সমাজে ভালো অবস্হানে আছেন তাঁদেরও উচ্চস্বরে বলতে হবে ‘ আমরা আমার বাংলাদেশে ভালো আছি, তুমি বাপু কে?’ আমাদের মনে রাখতে হবে ‘সবার আগে দেশ’। বর্তমানে বাংলাদেশে সংখ্যা লঘু নির্যাতন হচ্ছে মর্মে যে ‘ট্যাগ’ লাগানোর চেষ্টা চলছে তা ধর্মীয় কারনে নয়, ভিন্ন কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। সেই ফাঁদে আমরা মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কেউই যেন পা না দেই। সেরকম কিছু হলে আমাদের কারও অস্তিত্বই রক্ষা পাবে না- তা আমরা মুসলিমই হই বা হিন্দু বা অন্য কোন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ । অতএব সাধু সাবধান।
তথ্য সূত্র: কে এম কামরুজ্জামান সেলিম/ফেসবুক থেকে নেওয়া
https://slotbet.online/