রূপরেখা তৈরির প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন কিংবা খুব কাছ থেকে দেখেছেন এমন কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে রূপরেখা তৈরি সম্পর্কে কয়েক ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।
এরশাদ বিরোধী তিন জোটের মধ্যে আলোচনা ও কর্মসূচি সমন্বয়ের জন্য গঠিত লিয়াজো কমিটিতে ছিলেন বিএনপির এখনকার জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ডঃ খন্দকার মোশাররফ হোসেন। মি. হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন এই লিয়াজো কমিটিই রূপরেখাটি চূড়ান্ত করেছিলো।
সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন তখনকার তিন জোটের নেতাদের পরামর্শে রূপরেখার খসড়াটি তিনিই দাঁড় করিয়েছিলেন, যা পরে তিন জোটের লিয়াজো কমিটিতে পরিমার্জন করার পর বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন পেয়ে চূড়ান্ত হয়।
অন্যদিকে নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের একজন নুর আহমেদ বকুল বলছেন তারা তখনকার আওয়ামী লীগ নেতা টাঙ্গাইলের প্রয়াত আব্দুল মান্নানের ঢাকার বাসায় রূপরেখাটির খসড়া দেখেছিলেন। মি. বকুল এখন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।
আবার আরেকটি বর্ণনায় জানা যায় রূপরেখাটির একটি খসড়া হাতে লিখেছিলেন রাশেদ খান মেনন। এর ভিত্তিতে তিনটি জোটে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। পরে এর ভিত্তিতে ডঃ কামাল হোসেন, প্রয়াত আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ ও আব্দুল মান্নান খসড়াটি পরিমার্জন করেন।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে আব্দুস সালাম তালুকদার, আব্দুল মতিন চৌধুরী, খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ আরও কয়েকজন এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
এটিই পরে তিন জোটকে দেয়া হয় নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য। জোটগুলো নিজেরা আলোচনা শেষে লিয়াজো কমিটি তা চূড়ান্ত করে। এরপর তিন জোটের আলাদা আলাদা সমাবেশ থেকে রূপরেখা ঘোষণা করা হয়।
তবে এ রূপরেখার পটভূমি ছিল ১৯৮৮ সালের নির্বাচন। যার পর থেকেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করে।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করেছিলো। তখন নির্বাচনে মাত্র ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল।
আন্দোলন ব্যাপক গতি পায় ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে এবং আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যেও ইস্যুভিত্তিক ঐক্য গড়ে ওঠে। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও দুটি জোট হয় তখন।
এর মধ্যে দশই অক্টোবর ছাত্রদল নেতা জেহাদ মারা যাওয়ার পর জেহাদের মরদেহ সামনে রেখেই ২৪টি ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করে। এরপর সাতাশে নভেম্বর গুলিতে ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন নিহত হলে এরশাদের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
মূলত এই ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বেই তুমুল আন্দোলন হয়, যার জের ধরে নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে পদত্যাগে সম্মত হন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
কিন্তু এর আগে থেকেই এরশাদ কীভাবে পদত্যাগ করবেন বা কার কাছে পদত্যাগ করবেন তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো রাজনৈতিক অঙ্গনে। কারণ এরশাদ পদত্যাগ করলে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদের কাছেই করতে হতো।
“তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ চাই ও এরশাদের পতন চাই-এমন দাবি ছাত্রদের মধ্য থেকেই উঠেছিলো। এ কারণে একটি রূপরেখার কথা ওঠে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বৈঠকে। প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল মান্নানের বাসায় এ নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ আন্দোলনরত দলগুলোর নেতাদের মধ্যে। এর মধ্য দিয়েই রূপরেখাটি তৈরির কাজ শুরু হয়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা নুর আহমেদ বকুল।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলছেন যে নেতাদের আলোচনার ভিত্তিতে রূপরেখার খসড়ার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিলো এবং ওই কমিটিতে থেকে তিনিই খসড়াটি লিখেছিলেন।
“আমরা এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর কিভাবে করবে, নির্বাচন কীভাবে হবে এবং নির্বাচনের পর দেশ ও রাজনীতি কিভাবে এগুবে সেগুলোর ভিত্তিতে একটা খসড়া তৈরি করলাম। আমরা তাতে তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা লিখেছিলাম। পরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরামর্শে ‘তিনটি নির্বাচন’ বাদ দিয়ে শুধু পরবর্তী নির্বাচনের কথা লেখা হয় রূপরেখায়,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ অবশ্য বলছেন রূপরেখাটিতে ক্ষমতা হস্তান্তর ও নির্বাচনের দিক নির্দেশনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পূর্ণ ছিলো।
“তবে এতে কিন্তু জোটগুলো কোন স্বাক্ষর করেনি। তারা তখন সমাবেশ থেকে ঘোষণা দিয়েছিলো। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর না থাকায় ঐক্যমত থাকা সত্ত্বেও এটি একটি জাতীয় সনদ হতে পারেনি,” বলছিলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
https://slotbet.online/
[…] […]