টাঙ্গন ডেস্ক : যশোর জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার একটি ভিডিও নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয়। ভিডিওতে দেখা যায় ৩ জনের মধ্যে দু’জনের মুখমন্ডল কালো কাপড়ে ও আরেকজনের মুখ সাদা কাপড়ে ঢাকা। কালো কাপড়ে যাদের মুখ ঢাকা তাদের হাতে অস্ত্র। আর সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা ব্যক্তিকে আরবি ভাষায় কিছু বলতে শোনা গিয়েছে।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এটি সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ-বিশ্লেষক অনেকের প্রোফাইল থেকে শেয়ার হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যমেও এ নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়েছে। যদিও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় পুলিশ বুধবার রাতেই জানিয়েছে, ভিডিওটিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, আসল ঘটনা সে রকম না। যে কওমি মাদ্রাসাটি নিয়ে এখন এত আলোচনা হচ্ছে, তার অবস্থান যশোর শহরেই।
যশোর পুলিশ সুপার (এসপি) জিয়া উদ্দিন আহমেদ জানান, গত মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) ওই মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। অনুষ্ঠানে অনেক ধরনের পর্ব ছিল। সে রকম-ই একটি পর্ব হলো ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে যে তিনজনকে দেখা গিয়েছে, তারা ওই মাদ্রাসারই শিক্ষার্থী।
তিনি আরও বলেন, তারা ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামকে উপস্থাপন করতে চেয়েছে। এটা বাচ্চারা করেছে। কোনোকিছু না বুঝে তারা এটি করে ফেলেছে। আর সেখানকার যারা আয়োজক তারাও বিষয়টি বুঝে উঠতে পারে নাই। কেউ বিভ্রান্তির জন্য গতকাল রাতে অনুষ্ঠানের একটি ক্লিপ ছড়িয়ে দিয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হলে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তারা জানতে পেরেছেন, ভিডিওতে যে অস্ত্র দেখা গিয়েছে তা মূলত কাঠ ও শোলা দিয়ে তেরি “অস্ত্রসদৃশ একটি বিষয়”। তাদের ভেস্টও নকল ছিল।
এ ব্যাপারে ওই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকীও গতকাল গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। তার ভাষ্য, “ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনের ওপর যে হামলা করেছে তার প্রতিবাদ করার জন্য এটি করেছে। কিন্তু এটাকে একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার জন্য এটি করেছে।”
ইসলামিক ফাউন্ডেশন হালাল সনদ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মো. আবু ছালেহ পাটোয়ারী এ বিষয়ে জানিয়েছেন, সেখানে ফিলিস্তিন ও বায়তুল মুকাদ্দাসে মুসলমানদের ওপর চলমান অত্যাচারের কথা বলা হয়েছে। জিহাদ সংক্রান্ত কথাও বলা হয়েছে।
এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার কারণে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন বাংলাদেশ এর আগে যেসব জঙ্গি হামলার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তারা এর সাথে মিল দেখছেন।
২০১৬ সালের পহেলা জুলাই রাতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা হয়। সেই হামলার ১৭ জন বিদেশিসহ নিহত হন মোট ২২ জন্য তাদের মধ্যে দুইজন ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা।
সেই হামলাকারীদের আগে রেকর্ড করা যেসব ভিডিও প্রচার করা হয়েছিল, তাতে তাদের কালো পোশাক পরে, অস্ত্র হাতে আরবিতে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় যেসব ভিডিও প্রচার করেছে, সেখানেও এরকম অস্ত্র হাতে কালো পোশাক পরে নানা ব্যক্তিদের বক্তব্য দেয়ার দৃশ্য রয়েছে। ফলে অনেকেই যশোরের এই ভিডিওর সাথে অনেকে সেসব ভিডিওর মিল দেখতে পেয়ে আতঙ্ক বোধ করেছেন।
বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের ছয়ই মার্চ যশোরের টাউন হল ময়দানে উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর সম্মেলনে বোমা হামলার ঘটনাকে জঙ্গিদের উত্থানের বড় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ২০০১ সালে ঢাকায় রমনার বটমূলে ও সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা, এরপর সিনেমা হল, গির্জায়ও হামলার ঘটনার সাথে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ।
২০০৫ সালের অগাস্টে সিরিজ বোমা হামলায় উঠে আসে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি বা জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের নাম। এরপরেও বিভিন্ন সময়ে বিদেশি নাগরিক হত্যাসহ নানা ঘটনায় জঙ্গিদের নাম আসে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জানিয়েছে, জঙ্গি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও পুরোপুরি নিমূর্ল করা সম্ভব হয়নি।
ফলে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবার জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে কিনা, তা ভেবে অনেকে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। এখন হঠাৎ করে বাংলাদেশের এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার মাঝে এই ধরনের ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ অনুষ্ঠানের যথার্থতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
মো. শিহাবুল ইসলাম নামক একজন বাংলাদেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী ফেসবুকে প্রশ্ন করেছেন, “এরা কারা ? হাতে কী ? এরা কী চায় ? জঙ্গি স্টাইলে ইসলাম বা কালেমা প্রাচারের নামে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কেন?”
যেমন, ফেসবুকে এসএম আল-আমীন নামক একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীকে উদ্দেশ করে মন্তব্য করেছেন, “আপনার ধর্মে ত্রিশুল হাতে কখনও শিব, কখনও রাবণ, কখনও রাম বা কালি কারও বুকে উঠে কাউকে খুন করছে; এগুলো সাজতে দেখেছেন। হ্যাঁ, ঠিক এমনই ছেলেগুলো ফিলিস্তিনের হামাস যোদ্ধার সাজে অভিনয় করেছিলো।”
এই ঘটনা নিয়েও বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় নিজের ভেরিফায়েড অফিশিয়াল ফেসবুক ও এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন। তিনি লিখেছেন, ওই তিনজন জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আদলে সেজেছেন।
“অস্ত্র প্রদর্শন এবং জনস্মমুখে বক্তব্য দেওয়ার এই ধরনের প্রকাশ্য ঘটনাগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্বারা প্রতিরোধ করা হয়েছিলো।” কিন্তু ইউনূস সরকারের অধীনে এই গোষ্ঠীগুলো আবার জনবল সংগ্রহ করছে।
যদিও ওই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের তরফ থেকে বারবার করেই বলা হয়েছে যে শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামে একাত্মতা জানাতে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী “হামাসের আদলে” সেজেছেন।
এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলেন, “এগুলা যারা করেছে, তাদের বোঝা উচিত ছিল যে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটি কোন দিকে যাবে। আর ফিলিস্তিনের প্রতি একাত্মতা অন্যভাবেও জানানো যেত।”
তার মতে, এই ধরনের পরিস্থিতিতে “বুদ্ধিমত্তা দিয়ে না চললে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।” কারণ, “তারা হয়তো বলছে তারা হামাসের আদলে সাজছে। কিন্তু যারা এটিকে ভিন্ন খাতের দিকে নিতে চায় তারা বলবে- না, এটি আল-কায়েদার সিস্টেমে সাজছে।” তিনি মনে করেন, একদলের “বোকামি কারণে” এখানে “অপব্যাখ্যার সুযোগ” তৈরি হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ড. সাদেকা হালিম এ বিষয়ে বলেন, “এরকম কট্টরপন্থী একটি বিষয়কে যদি মস্তিষ্কের মাঝে ঢুকিয়ে ফেলি এবং যেমন খুশি তেমন সাজো’র মধ্যে নিয়ে আসি তাহলে এটি সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য ভালো না।” তবে তিনি এও মনে করেন যে এই ধরনের বিষয়ের অনুপ্রবেশ বহুদিন ধরেই সমাজে ঘটছে।
“ইন্টারনেটের যুগে সবকিছু ওদের হাতের নাগালে। কোমলমতি শিশুরা ওই ধরনের কাপড়-চোপড় পরছে। আমাদের দেশে শিশুদের হাতে খেলার জন্য বন্দুক দেওয়া হয়।” তবে এগুলো খেলা বলা হলেও আদতে তা শিশুদের মস্তিষ্কের প্রভাব ফেলে।
তথ্য সূত্র : বিবিসি বাংলা।
https://slotbet.online/