পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে সংসদ সদস্যদের ছাড়িয়ে গেছেন উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা। সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের সম্পদ বৃদ্ধির হার ৪ হাজার ২০০ শতাংশের বেশি। বেড়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যাও। এবার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে কোটিপতির সংখ্যা ১১৭।
গতকাল ধানমন্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি কার্যালয়ে উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানিয়েছে সংস্থাটি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পদ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। এগুলো নির্বাচন কমিশন, এনবিআর ও দুদকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি প্রথম ধাপে মন্ত্রী-এমপিদের ১৩ জন স্বজন নির্বাচন করছেন। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচন দলীয় হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীর অধিকাংশই ‘আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী’ এবং দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটি স্থানীয় প্রার্থীদের আটকাতে পারেনি। আগ্রহী প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের হস্তক্ষেপ বড় আলোচনার বিষয় হলেও এবার স্বজনদের মনোনয়ন নিয়ে চলছে বিতর্ক। বর্জনের ঘোষণা দিলেও তা অমান্য করে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় ৭৩ জনকে বহিষ্কার করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করলেও জামায়াতে ইসলামীর ২২ নেতা পরবর্তী সময়ে দলের সিদ্ধান্তে সরে দাঁড়িয়েছেন। প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি বলছে, নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৫০ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৫৬০, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬১১ এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৩৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৫৬০ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে কোটিপতি ৯৪ জন। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কোটিপতি ছিলেন ৩৭ জন।
গত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনায় এ সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ১৭ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ছয়জন কোটিপতি। গত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনায় এ দুই পদের ক্ষেত্রেও কোটিপতির সংখ্যা তিন গুণের কাছাকাছি। টিআইবি জানিয়েছে, অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে এ কোটিপতির হিসাব করা হয়েছে। ভূমির মতো স্থাবর সম্পদের মূল্য নির্ধারণ কঠিন হওয়ায় কোটিপতির হিসাবে তা আনা হয়নি। সংস্থাটি বলছে, পেশা হিসেবে চেয়ারম্যান প্রার্থীর ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন কৃষিকাজ।
তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন আইনজীবী (৬ শতাংশ) ও শিক্ষক (৪ শতাংশ)। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রায় ৬৭ শতাংশ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর ২৪ শতাংশ পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন ব্যবসা। আর নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর ৫২ শতাংশই নিজেকে দেখিয়েছেন গৃহিণী হিসেবে। আয় নেই ১২ শতাংশের। ৩৯ শতাংশ প্রার্থী দেখাননি নিজেদের আয়ের কোনো স্বীকৃত উৎস।
টিআইবি বলছে, জাতীয় সংসদের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীর সংখ্যা ২০১৪ সালের চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে গৃহিণী/গৃহস্থালি, কৃষিজীবী ও শিক্ষক প্রার্থীর পরিমাণ দিন দিন কমছে। টিআইবির গবেষণা বলছে, সার্বিকভাবে প্রার্থীর ৪০ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকার নিচে। অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী। প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে, বাকি ৭ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার বেশি।
অন্যদিকে ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমি আছে কমপক্ষে ১০ প্রার্থীর। আর ২৩ দশমিক ৪১ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীর। প্রার্থীর ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বর্তমানে মামলায় অভিযুক্ত। পাঁচ বছরে একজন চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩১৯ শতাংশ, ১০ বছরে এ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮২৩ শতাংশ। অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২৫১ শতাংশ।
স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৪০ শতাংশ। পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে এ হার সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের সম্পদ বেড়েছে ৪ হাজার ২০০ শতাংশের বেশি।
অস্থাবর সম্পদের শীর্ষে গোপালগঞ্জের কামরুজ্জামান : প্রার্থীর মধ্যে অস্থাবর সম্পদের তালিকার শীর্ষে আছেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী কামরুজ্জামান ভূঁইয়া। তাঁর মোট অস্থাবর সম্পদ ২৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। ২ নম্বরে আছেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার আনোয়ারুল ইসলাম। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রায় ১৯ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছেন আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরী।
আতাহারের বাবা একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য। আতাহারের মতো আরও দুজন প্রার্থী এ তালিকায় রয়েছেন, যারা সংসদ সদস্যদের স্বজন।
সবচেয়ে বেশি আয় বেড়েছে রামগড়ের প্রদীপ কারবারীর : ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তুলনায় আয় বৃদ্ধির দিক দিয়ে সবার ওপরে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারী। তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৩ হাজার শতাংশের বেশি। ১ হাজার শতাংশের বেশি আয় বেড়েছে আরও চার প্রার্থীর। তাঁদের দুজন নারী ভাইস চেয়ারম্যান ও দুজন চেয়ারম্যান প্রার্থী।
আরএম/ টাঙ্গন টাইমস
https://slotbet.online/