স্টাফ রিপোর্টার : ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে গণ উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ও উপজেলা যুবলীগ নেতা বেলাল উদ্দীনের বিরুদ্ধে, নিজের অপকর্ম ঢাকতে সমিতির সদস্য ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, চেক জালিয়াতি, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বাণিজ্য, জমি দখল, সমিতির টাকায় সুদের ব্যবসাসহ নানা অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। কারো কাছে নিয়েছেন ব্লাঙ্ক চেক, কারো কাছে ফাঁকা ষ্ট্যাম্পে স্বাক্ষর। কাউকে জিম্মি করে ঋণের কয়েক গুন টাকা আদায় করে হয়ে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। আর এসব করেছেন আওয়ামীলীগ সরকারের শাসন আমলে কতিপয় নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে।
ঠাকুরগাঁও জেলা সমবায় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা সমবায় কার্যালয়ের আওতায় পাঁচটি উপজেলায় মোট ৮৬২টি সমবায় সমিতি আছে। এর মধ্যে গণ উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লি:সহ ঝুঁকিপূণের তালিকায় ৭৭টি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা যুবলীগের অর্থ সম্পাদক বেলাল উদ্দীনের জন্ম ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মধুপুর গ্রামে। বাবা এক সময় শ্রমিকের কাজ করতেন। বেলালও শ্রমিকের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গণ উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। আর এই সমিতির সভাপতি নিজে, কখনো তার বাবা, আবার কখনো তার স্ত্রী। নিজের পরিবারের সদস্য ও পছন্দের লোকদের নিয়ে গঠন করেছেন ব্যবস্থাপনা কমিটি। সমবায় সমিতি আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করে দরিদ্র অসহায় মানুষদের ফাঁদে ফেলে জালিয়তির আশ্রয় নিয়ে করে গেছেন একের পর এক অনিয়ম, দূর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতা। আর এসব করেছেন আওয়ামীলীগ সরকারের শাসন আমলে কতিপয় নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা, দূর্নীতির মামলাসহ নানা অভিযোগ উঠলেও দলীয় প্রভাবের কারনে ভয়ে মুখ খুলেনি কেউ। আর টাকা দিয়ে সকলকে ম্যানেজ করে নিতেন সব কিছু। তার নিজ ফেসবুক আইডিতে ৫০ কোটির অধিক টাকার ছবি পোষ্ট করায় এক সময় ব্যাপক আলোচনায় আসেন এই নেতা।
গণ উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের উপ-আইনে বলা আছে, সমবায় সমিতি গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, সদস্যদের জীবন যাত্রার মানউন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচনের কথা। ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন পূর্বক লেনদেন করার কথা। এছাড়াও ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর নিবন্ধক ও মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত সার্কুলারে বলা আছে, সমবায় সমিতির সঙ্গে আর্থিক লেনদেনকারী সকল গ্রাহক/সদস্যদের পরিচিতি যাচাইকরণ ও সনাক্তকরণসহ হিসাবের লেনদেন মনিটরিং করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে প্রতিটি সমবায় সমিতিকে তার গ্রাহক/সদস্য/পাওনাদারের সঙ্গে ব্যাংকের মাধ্যমে সকল আর্থিক লেনদেন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি সমবায় সমিতির নিজ নামে তফসিলী ব্যাংকে চলতি/সঞ্চয়ী হিবাব থাকা আবশ্যক।
২০২২-২০২৩ অর্থ বছরসহ বিগত অর্থ বছরে গণ উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রস্তুতকৃত হিসাব নিরীক্ষাকালে সমিতির উদ্ধৃত্তপত্রের সহিত সমিতির রক্ষিত রেজিষ্টার সমূহের যথেষ্ট গড়মিল পড়িলক্ষিত হয়েছে। সমিতির হিসাব আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করার নিমিত্তে¦ সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩) এর ৪৯ (ঘ) ধারার প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিবন্ধকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো।
কিন্তু সমিতির সভাপতি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গেছেন একের পর এক অপকর্ম। দূর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো হাতে হাতে কোটি কোটি টাকার ঋণ লেনদেন করেছেন। আর এই ফাঁদে পড়ে অনেকে ঘর-বাড়ি ছেলে সর্বশান্ত হয়েছেন। কারো কাছে নিয়েছেন ব্লাঙ্ক চেক, কারো কাছে ফাঁকা ষ্ট্যাম্পে স্বাক্ষর। কাউকে জিম্মি করে ঋণের কয়েক গুন টাকা আদায় করে শূণ্য থেকে হয়ে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক।
গণ উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক কর্মচারী বেলাল উদ্দীন বলেন সমিতির সভাপতি বেলাল উদ্দীনের অপকর্ম আমি মেনে নিতে না পাড়ায় আমাকে চাকুরী চ্যুত করেছে। আমি তার কাছে সকল হিসাব-নিকাশ বুঝে দিয়ে চলে আসি। কোন দেনা পাওনা ছিল না। পরে আমাকে বলে তোমার কাছে ৫ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা পাবো। তার পরেও আমি জমি বিক্রী করে টাকা পরিশোধ করেছি। চাকুরীর সময় জামানত হিসেবে ব্লাঙ্ক চেক গুলো জমা ছিল, সে চেক গুলো ফেরত চাইলে বলে চিন্তা করো না, তোমাকে দিয়ে দিবো। পরে আমার বিরুদ্ধে ৪৩ লক্ষ টাকার ৩টি চেক ডিসঅনার মামলা দেয়। জায়গা জমি হারিয়ে নি:শ্ব হয়ে শ্বশুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।
বেলালের স্ত্রী বলেন সে আমাকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি দিতো, ছেলে-মেয়েদের অপহরণ করতে চাইতো। গেট ভেঙ্গে দেয়। আমার স্বামী বাসায় থাকতে পারতো না, খেতে পারতো না। আমি তার পাঁ গুলো ধরে বলেছি ভাই এ ভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ো না।
লাহিড়ী বাজার এলাকার এ তিশাত মনি বলেন সে কতগুলো পাশবই তৈরী করেছে যে গুলো নম্বার নেই, সে সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে হয়রানি দূর্নীতি করেছে। সে নিজে সভাপতি, কখনো তার বউ সভাপতি আবার কখনো বাবা সভাপতি। সে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে কতিপয় নেতাকে হাতে রেখে সকল ধরণের অপকর্ম করেছে। তার বিরুদ্ধে দূর্নীতি দমনে মামলা চলমান রয়েছে। তার বাবা এবং সে শ্রমিকের কাজ করতো। এখন সে কয়েক শত কোটি টাকার মালিক।
মাহাবুবুল আলম মানু বলেন আমি একজন ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী ৫০০ টাকা সঞ্চয় জমা করে ১ লাখ টাকার ঋণ গ্রহণ করি। জামানত হিসেবে একটা ব্লাঙ্ক চেক নেয়, ঋণ পরিশোধ করার পর চেকটা চাই, তখন আমাকে বলে চেক হারায় গেছে, চেকটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তীতে ওনার ভায়ের দ্বারা আমার নামে ৫৮ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার চেক ডিসঅনার মামলা দায়ের করে। সে প্রতারণামূলক ব্যবসা শুরু করেছে। এই চক্রের হোতা সভাপতি বেলাল উদ্দীন।
মনজর আলম বাবু বলেন আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গ্রহণ করেছি ৩ লক্ষ ২০ হাজার টাকা সে আমার নামে মামলা করেছে ৯ লক্ষ টাকার। বিষয়টি নিয়ে মিমাংসার চেষ্টা করলে আমার কাছে ১৫ লক্ষ টাকা চায়। সে আমাদের এলাকার একজন বড় ধরণের সুদারু এবং সে সন্ত্রাসী কায়দায় মানুষকে বিপদে ফেলে মানুষকে নি:শ্ব করে, আমাকেও সে নি:শ্ব করেছে।
তিনি আরও বলেন সে যুবলীগের প্রভাব দেখিয়ে মানুষকে হয়রানি, জলুম, অত্যাচার, নির্যাতন চালাতো। সে পঞ্চগড়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিক্রী করতে গিয়ে ধরা পরে এবং হাজত বাস করে। সে মাডার মামলার আসামি ছিলো, আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সে টাকার বিনিময়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে চার্জশীট থেকে নাম দেওয়ায়। তিনি আরও বলেন তার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ আছে।
আব্দুল মজিদ নামে এক গ্রাহক বলেন আমি দুইটি বইয়ে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা পাবো। আরো অনেক টাকা পাইতাম, কিছু টাকা দিয়েছে, বাকি টাকার জন্য ঘুরাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন আমি প্রতিদিন ১০০ টাকা করে ৬ বছর মেয়াদে টাকা জমা করতাম। মেয়াদ শেষে সে টাকা ফেরৎ দেওয়ার কথা, কিন্তু ১০ টাকা দেওয়ার পরে ২ লক্ষ টাকা আজ দিবেন কাল দিবেন বলে শুধু ঘুরাচ্ছেন। দরিদ্র পরিবারের এক নারী বলেন আমি ৫০ হাজার টাকা রেখেছি। টাকা গুলো যে কবে পাবো সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি।
আরেক নারী বলেন আমার স্বামী মারা যাওয়ার পরে ৬ বছরের জন্য আমি ১ লক্ষ টাকা জমা রাখছি, আজকে দেওয়ার কথা কিন্তু আমাকে আরেকদিন আসতে বলছে। এমন অভিযোগ শতশত বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন গণ উন্নয়ন সমবায় সমিতির সভাপতি বেলাল উদ্দীন সু-পরিকল্পিত ভাবে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্নসাতের জন্য প্রতিবছর ঋণ খেলাপি দেখিয়ে আসছেন। কিন্তু এ সব ঋণ খেলাপি তিনি নিজেই ইচ্ছে করে করেছেন। এখন সাধারণ মানুষের জমানো টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করছেন।
গণ উন্নয়ন সমবায় সমিতির সামনে ব্যবসা করেন ইসলাম উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি জানান বেলাল আমার জমি রাতারাতি দখল করে। জমির সব কাগজপত্র ঠিক আছে, খাজনা, খারিজ করেছি। কিন্তু দলীয় প্রভাব খাটিয়ে সে আমার জমি দখল করে।
গণ উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা যুবলীগের অর্থ সম্পাদক ব্লাঙ্ক চেক, ফাঁকা ষ্ট্যাম্পে স্বাক্ষর গ্রহণসহ কমিটিতে বাবা, স্ত্রীর কথা স্বীকার করে বলেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকল ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমি কারো জমি দখল করিনি। আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ মিথ্যা প্রমানিত করেছি।
ঠাকুরগাঁও জেলা সমবায় কার্যালয়ের উপ-সহকারী নিবন্ধক এ কে এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন জেলা সমবায় কার্যালয়ের আওতায় পাঁচটি উপজেলায় মোট ৮৬২টি সমিতি আছে। এর মধ্যে গণ উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি লি:সহ ঝুঁকিপূণের তালিকায় ৭৭টি। সব সমিতির আর্থিক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে পরিচালনা করার পরিপত্র থাকলেও কিন্তু তার বিরুদ্ধে অনিয়নের বিষয় উঠলে গঠন করা হয় ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। তদন্ত শেষে ফাইন্ডআউট করে প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন গণ উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি কর্তৃপক্ষ এলাকার মানুষের সাথে বিধি-বিধান না মেনে কাজ করলে এবং কোন মানুষকে হয়রানির শিকার করলে তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ইসলাম/টাঙ্গন টাইমস
https://slotbet.online/