অ্যাডভোকেট আবু মহী উদ্দীন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রামের পটিয়ায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে মাঠে নামেন ইলিয়াস কাঞ্চন। এর আগে ১৯৮৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ইলিয়াস কাঞ্চনও গুরুতর আহত হন, তার পা কেটে ফেলারও পরামর্শ দেন চিকিৎসক। জাহানারা কাঞ্চনের বাধার মুখে পরে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় এই নায়ককে। দীর্ঘ তিন মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আবারও অভিনয়ে যুক্ত হন কাঞ্চন।
জীবন সঙ্গীর মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় ইলিয়াস কাঞ্চনকে। তার উদ্যোগে ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন-বিএফডিসি থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামে একটি পদযাত্রা হয়। প্রথম সেই পদযাত্রা থেকে এটিকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার পরামর্শ দেন বিশিষ্ট জনেরা। পদযাত্রা শেষে ২২ দফা সুনির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
প্রতিবারের ন্যায় এবারও ঠাকুরগাঁও জেলা শাখা ১ ডিসেম্বর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করে।
পরবর্তীকালে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে যান এই অভিনেতা, আয়োজন করতে থাকেন পথযাত্রার। সেগুলো থেকে ২২ দফা দাবিতে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন প্রসার লাভ করে, তৈরি হতে থাকে জনমত। দেশের ভেতরে নিরাপদ সড়কের দাবি বা আন্দোলনকে জোরালো ভিতের পর দাঁড়াতে সাহায্য করে। পদযাত্রা থেকে যে ২২ দফা সুনির্দিষ্ট দাবির প্রস্তাব উত্থাপন করেন ইলিয়াস কাঞ্চন, তা দেশের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মূল স্পিরিট হিসেবে কাজ করেছে।
নিসচার পক্ষ থেকে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে ২০০৪ সালের ৭ এপ্রিল একটি সভার আয়োজন করে জাতিসংঘ। সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনতে ২০১০-২০ সালকে ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’ ঘোষণা করে সংস্থাটি। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় ২০৩০ পর্যন্ত বাড়ানো হয় সময়সীমা।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে একে একে আরও তিনটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি, ২০০৭ সালে সেভ দ্য রোড এবং ২০১৪ সালে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব সংগঠন সড়কের পাশাপাশি রেল, নৌ ও আকাশ পথে দুর্ঘটনা নিয়েও কাজ করছে । বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে বর্তমান সময়ে সড়কে সব চেয়ে বেশি প্রানঘাতী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার চিত্র।
নিরাপদ সড়ক চাই ২০১২ সাল থেকে, সেভ দ্য রোড ২০১৪ সাল থেকে, যাত্রীকল্যাণ সমিতি ২০১৫ সাল থেকে, এবং রোড সেফটি ২০১৯ সাল থেকে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্র্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। মাস ও বছর ভিত্তিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি বর্তমানে ঈদযাত্রার সময়েও আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে সংগঠনগুলো। এসব প্রতিবেদনে কোন যানবাহনে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটছে, কেন দুর্ঘটনা ঘটছে, কোন ধরনের মানুষ দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে এসব-সহ দুর্ঘটনা কমাতে বেশ কিছু সুপারিশও তুলে ধরছে তারা।
দীর্ঘ সময়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনটি এখন আইকনিক শ্লোগান। ইলিয়াস কাঞ্চন এবং নিরাপদ সড়ক চাই একে অপরের সমার্থক। শতভাগ স্বেচ্ছাসেবী এই আন্দোলন সারাদেশে দানা বাধে। দাবী ওঠে দেশে একটা নিরাপদ সড়ক দিবস থাকা দরকার। অবশেষে সরকার ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করে , এবংএখন তা সরকারিভাবে পালন করা হয়। সরকারিভাবে পালন করতে গিয়ে বিষয়টি একটা ফ্রেমের মধ্যে বন্দী হয়ে যায়। বিষয়টি দায়সাড়া পর্যায়ে পড়ার অভিযোগ থেকে মুক্ত হবে কি করে ?
২০২২ সালের অক্টোবরের ৩১ দিনে দেশে ৪২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩৭ জন নিহত এবং ৬৮১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৪ জনের প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন ৭৬ জন। মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার এ সংখ্যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ শতাংশ, আর মৃত্যুর সংখ্যা ৩৩ শতাংশ। এ সময় রেলপথে ২৯টি দুর্ঘটনায় ৫৩ জন নিহত এবং ১৫৫ জন আহত হয়েছেন। আর নৌ-পথে ছয়টি দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত, ২ জন আহত এবং ২ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
অক্টোবরে সড়কে দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪ জন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ১২০ জন চালক, ৩৬ জন পথচারী, ২৮ জন পরিবহন শ্রমিক, ৫২ জন শিক্ষার্থী, ৩ জন শিক্ষক, ৬৮ জন নারী, ৩০ জনশিশু, ২ জন সাংবাদিক, ২ জন চিকিৎসক, ১ জন আইনজীবী, ১ জন প্রকৌশলী এবং ১০ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীর পরিচয় মিলেছে।
মোট দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ১৩ শতাংশ হয়েছে জাতীয় মহাসড়কে। এছাড়া ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৩০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে।
এই পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে ঠাকুরগাওয়ে এই দিবস উদযাপনের হালচাল আলোচনার দাবী রাখে। ২০২২ এ দিবস উদযাপন হয়েছে ডিসি অফিসের গাছতলাতেই , একক বক্তা এডিএম সাহেব। তিনি প্রজাতন্ত্রের এবং ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসনের অসম্ভব ব্যস্ত এবং অত্যাবশ্যক একজন কর্মকর্তা। এস সব গৌণ কাজে ব্যয় করার মতো সময় তার থাকা উচিত নয়। তার ব্যস্ততার কারণে অংশগ্রহণ কারীরা ডিসি অফিসের মিলনায়তনেও ১০ মিনিটের জন্য বসার সুযোগও পাননি। অংশগ্রহনকারীরা নিচে দাঁড়িয়ে থেকে তার অমীয় বানী শুনে ধন্য ধন্য করে চলে গেছেন। তিনি কেবলমাত্র বক্তৃতার সময় আবির্ভুত হলেন , বক্তৃতা উপহার দিলেন , মিনিট পাঁেচকের বক্তৃতার মধ্যে সাড়ে তিন মিনিট ই তার ব্যস্ততার ফিরিস্তি দিলেন। বাঁকী দেড় মিনিট নিরাপদ সড়কের কথা। তিনি চেনার বা জানার সুযোগও পেলেনা , প্রয়োজন ও মনে করেননি, এই আয়োজনে কারা , কেন এসেছিল , বা এটা কাদের অনুষ্ঠান?
২০২৩ সালেও ১৫ মিনিটের র্যালী শেষে এবারে অবস্থার একটু উন্নতি হয়েছে। তা হলো ডিসি অফিসের আমগাছতলার পরিবর্তে মিলনায়তনে বসার সুযোগ হয়েছিল। তবে সমস্যা একটাই, তাহলো আমাদের সব কিছুই আছে কেবল মাত্র সময় নাই। সেদিন অনেকগুলো মিটিং ছিল। যদিও সবগুলো জাতীয় দিবস উদযাপন সংক্রান্ত নয়। সে কারণে এই আলোচনা সভা তো বটেই আমার ধারণা অন্য মিটিংগুলোরও এই পরিনতিই হয়েছে।
আমার ধারণা কোন মিটিংই প্রয়োজনীয় সময় পায়নি। আলোচনা খুবই সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ব্যস্ত থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের নিয়োগই করা হয় ব্যস্ত থাকার জন্য। এতে আমাদের কোন মন্তব্য নেই। তবে তারা নিজেদের অত্যাবশ্যক মনে করেন কেন ? আলোচনা সভায় তারা যতটুকু সময় দিতে পারবেন দিবেন, তার পর চলে যাবেন। তিনি শারীরিক ভাবে উপস্থিত থাকতে পারলেন না সে জন্য গোটা প্রোগ্রাম বন্ধ করতে হবে তা তো হয় না।
আলোচনা সভায় বাস, মিনিবাস , কোচ, মাইক্রেবাস মালিক সমিতি, জেলা ট্যাংক লরি মালিক সমিতি, জেলা ট্যাংকলরি শ্রমিক ইউনিয়ন, মোটর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, জেলা যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটি, নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠন সমুহের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল। তাদের প্রতিটি সংগঠনের আলাদা আলাদা সমস্যা, এই সব সমস্যাই নিরাপদ সড়ক এবং সড়ক আইন ২০১৮ বাস্তবায়নের অন্তরায়। বিআরটিএ, পুলিশ প্রতিনিধিরা আলোচনা করবেন, গত বছর থেকে ১ বছর আমরা কতটুক ুকরতে পেরেছি, আরো কি করা দরকার? কোনটি ভালো করেছে, কোনটি করতে পারিনি এসব বিষয় বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার।
এডিএম সাহেবের ব্যাস্তোতার কারণ কিছুই হলো না। সরকারি দ্বায়িত্ব পালন হয়েছে, ফেসবুকে ছবি গেছে, সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের অতটা অত্যাবশ্যক ভাববেন না। গোটা ১ বছরে ১টা দিন ঘন্টা খানেক সময় দেওয়া গেলো না? কেননা দায়িত্ব এবং ক্ষমতা থাকার পরও আপনারা সড়ক নিরাপদ করতে পারেন নি। এই কাজে জনসম্পৃক্ততা প্রয়োজন। সেটাও আপনারা করতে পারেননি। সে কারণেই তো স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করা দরকার। রোড সেফটির জেলা এবং আঞ্চলিক কমিটি আছে। নিরাপদ সড়ক চাই এই কমিটির সদস্য। গত ২ বছর এই কমিটির কোন মিটিং হয়েছে বলে জানা নাই।
তাহলে হিসাব মেলাতে হবে, এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে সড়ক ব্যবস্থা নিরাপদ হতে কত বছর প্রয়োজন হবে ? নিরাপদ সড়কের আকাঙ্খা অধরাই থেকে যাবে ?
লেখক/গবেষক
https://slotbet.online/